
বর্তমানে জ্ঞানের পরিধি সৃষ্টি, বৃদ্ধি ও প্রসারিত হয়েছে বহু বছরের পরিক্রমায়। বিভিন্ন দার্শনিক, চিন্তাবিদ, বহুবিদ্যাবিশারদ এবং মনীষীদের মাধ্যমেই মুক্তজ্ঞানের বিকাশ ঘটেছিল। প্রথমদিকে যেকোনো ঘটনার যৌক্তিক ব্যাখ্যা প্রদানের মাধ্যমে জ্ঞানার্জনের যেই যাত্রা শুরু হয়, আজ তা এক্সপেরিমেন্টে রূপ লাভ করেছে। তবে এতোকিছুর জন্যে মানবজাতিকে বহু শতাব্দী অপেক্ষা করতে হয়েছে। প্রতিটি শতাব্দীতে জন্ম নেওয়া অসাধারণ মেধা ও প্রতিভার অধিকারী দার্শনিক ও শিক্ষাবিদের জ্ঞানচর্চা ও গবেষণার মাধ্যমে সভ্যতা এগিয়ে যেতে শুরু করে। আজকের এই আর্টিকেলে আমরা মধ্যযুগ তথা ইসলামের স্বর্ণযুগের কিছু মুসলিম মনীষী সম্পর্কে জানবো, যাঁদের অবদান ও কর্ম ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লিখিত রয়েছে, যা বিশ্ববাসী কখনো ভুলবে না। সে সময়টি ইউরোপের জন্য ছিল অন্ধকার যুগ। তবে মুসলিম সভ্যতা দিনে দিনে এগিয়ে যাচ্ছিল এবং পরবর্তীতে বিভিন্ন বিজ্ঞানী তাদের করা গবেষণা ও মৌলিক কাজের উপর ভিত্তি করে নতুন বিষয় উদ্ভাবন বা আবিষ্কারে সক্ষম হয়েছিলেন। সে সময়ের মুসলিম গবেষকেরা জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রায় সব শাখাতেই বিচরণ করেছিলেন, যা ইতিহাসের পাতায় খুব কমই দেখা যায়। যদিও তাঁদের অনেক কাজ ষড়যন্ত্রমূলকভাবে নষ্ট করা হয়েছে, তবে যতটুকু পাওয়া যায় সেগুলোও আধুনিক বিজ্ঞানের প্রগতিতে ও ভিত্তি তৈরিতে যথেষ্ঠ ভূমিকা রেখেছে। তো, চলুন, সেই সোনালি যুগের কয়েকজন সোনালি মানুষ সম্পর্কে জেনে নেওয়া যাক।
জাবির ইবনে হাইয়ান
আবু আব্দুল্লাহ জাবির ইবনে হাইয়ান দক্ষিণ আরবের আযদ বংশে ৭২২ খ্রিষ্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি একজন বিখ্যাত অ্যালকেমিস্ট। তাকে অনেকে রসায়নের জনক বলে থাকেন। জাবির ইবন হাইয়ান আলকেমিতে পরীক্ষণমূলক পদ্ধতির আবির্ভাব ঘটিয়েছিলেন। কেউ কেউ তাঁকে “আল হাররানী” এবং “আস সুফী” বলে থাকেন। জাবির তাঁর জীবনের অধিকাংশ সময়ই বাগদাদে কাটিয়েছেন। গ্রিক ভাষায় সুপণ্ডিত জাবির ইবনে হাইয়ান কুফায় চিকিৎসা জীবন শুরু করলেও এর মধ্যে তিনি রসায়নশাস্ত্রে উচ্চতর জ্ঞান অর্জন করেন। সেখানে তিনি একটি বিজ্ঞানাগার প্রতিষ্টা করে মৃত্যু পর্যন্ত গবেষণারত ছিলেন। তাঁর গবেষণা অনেক সমৃদ্ধ ও মৌলিক ছিল। তিনি বস্তুজগতকে প্রধানত তিন ভাগে বিভক্ত করেনঃ স্পিরিট,ধাতু এবং যৌগিক পদার্থ। হাইড্রোক্লোরিক এসিড ও নাইট্রিক এসিড সংশ্লেষণ, পাতন এবং কেলাসীকরণ তাঁরই আবিষ্কার। তিনি নাইট্রিক ও সালফিউরিক এসিডের সর্বপ্রথম আবিষ্কারক। ধাতুর শোধন, তরলীকরণ, বাষ্পীকরণ, ইস্পাত তৈরির প্রক্রিয়া, লোহার মরিচা রোধক বার্নিশ, পরিস্রবণ, গলানো প্রভৃতি বিষয় সম্পর্কে বিস্তারিত ব্যাখ্যা লিখে রেখেছিলেন। তিনি চিকিৎসাশাস্ত্র, রসায়ন, জ্যামিতি, জ্যোতির্বিজ্ঞান, দর্শন, যুদ্ধবিদ্যা, কাব্য ইত্যাদি সম্পর্কে দুই হাজারেরও বেশি গ্রন্থ রচনা করে্ছিলেন। এই জ্ঞান তাপসের অবদানে মধ্যযুগের বিজ্ঞানচর্চা অনেকখানি সমৃদ্ধ হয়েছিল, যার কারণে ইতিহাসের পাতায় তাঁর নাম স্বর্ণাক্ষরে লিখিত থাকবে।
ইবনে রুশদ
আবুল ওয়ালিদ মুহাম্মাদ ইবন আহমাদ ইবনে রুশদ একজন দার্শনিক, চিকিৎসাবিদ, ধর্মতত্ত্ববিদ এবং জ্যোতির্বিদ ছিলেন। পাশ্চাত্যে তিনি “ব্যাখ্যাদাতা” এবং “যুক্তিবাদের জনক” হিসেবে বিখ্যাত। ইবনে রুশদের মতে ধর্ম ও দর্শন সাংঘর্ষিক নয়। তিনি অ্যারিস্টটলের দর্শনের বস্তুবাদী দিক বিকশিত করার চেষ্টা করেন। দার্শনিক রুশদ প্লেটোর “রিপাবলিক” এবং অ্যারিস্টটলের “নিকোমেকিয়ান এথিকস” এর পূর্ণাঙ্গ ভাষ্য তুলে ধরেছিলেন। ইবন রুশদ বলেন, “দর্শনের চর্চা ইসলামের মধ্যে পুরোপুরি অনুমোদিত এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে তা বাধ্যতামূলক।“প্রাচ্যবিদ আর্নেস্ট রেনানের মতে ইবন রুশদের অন্তত ৬৭ টি স্বতন্ত্র রচনা বিদ্যমান। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি গ্রন্থ হলো “আল জামি”, “আল কুল্লিয়াত ফি আত তিব্ব” এবং “বিদআত আল মুজতাহিদ ওয়া নিহায়াত আল মুকতাসিদ”। ইবন রুশদ বুদ্ধিবৃত্তি, সময়, মহাকাশীয় গোলক ইত্যাদির উপর বেশ কয়েকটি স্বতন্ত্র দার্শনিক গবেষণাপত্র লিখেছেন।
আল-রাযি
আবু বকর মুহাম্মাদ ইবন যাকারিয়া আল রাযি একজন বিখ্যাত চিকিৎসা বিজ্ঞানী ও শল্য চিকিৎসাবিদ। আরবীয় চিকিৎসাশাস্ত্রের দিকপাল ৮৬৫ খ্রিষ্টাব্দে (মতান্তরে ৮৬৪ খ্রি.) ইরানের তেহরানে জন্ম গ্রহণ করেন। তিনি চিকিৎসাবিজ্ঞান, অ্যালকেমি, পদার্থবিজ্ঞান এবং অন্যান্য বিষয়ের উপর ১৮৪টির বেশি বই লিখেছেন। তন্মধ্যে শতাধিক হলো চিকিৎসা বিষয়ক। ভীষণ মেধাবী এই মহান মনীষী জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় মৌলিক অবদান রেখেছেন। দীর্ঘদিন তিনি জুন্দেরশাহপুর ও বাগদাদে সরকারি চিকিৎসালয়ে অধ্যক্ষ হিসেবে কর্মরত ছিলেন। তৎকালে তাঁর সুনাম ও সুখ্যাতি চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়লে পশ্চিম এশিয়া ও পূর্ব ইউরোপ থেকে অনেক রোগী তাঁর নিকট আসতেন। শল্যচিকিৎসায় আল রাযি ছিলেন তৎকালীন শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি। তাঁর অস্ত্রোপচার পদ্ধতি ছিল গ্রীকদের থেকেও উন্নত। তাঁর দু’টি অসাধারণ গ্রন্থ হলো “আল জুদাইরি ওয়াল হাসবাহ” এবং “আল মানসুরি”। এ গ্রন্থদ্বয় আল রাযিকে চিকিৎসাশাস্ত্রে অমর করে রেখেচ্ছে। তিনি “আল জুদাইরি ওয়াল হাসবাহ” গ্রন্থে হাম ও বসন্ত সম্পর্কে এবং ১০ খণ্ডের “আল মানসুরি” গ্রন্থে এনাটমি, ফিজিওলজি, মেডিসিন, হাইজিন, শল্য চিকিৎসা, বিষ ইত্যাদি বিষয় সম্পর্কে আলোকপাত ও বর্ণনা করেছেন। আল রাযি হাম, শিশু চিকিৎসা, নিউরোসাইক্রিয়াটিক ইত্যাদি বিষয় সম্পর্কে নতুন মতবাদ প্রবর্তন করেন। তিনি ৯২৫ খ্রিষ্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন।
ইবনে সিনা
আবু আলী আল- সাইন বিন আব্দিল্লাহ ইবনুল হাসান বিন আলী ইবনে সিনা ছিলেন ইসলামি স্বর্ণযুগের অন্তম শ্রেষ্ঠ পারসিক চিন্তাবিদ, লেখক, চিকিৎসক এবং জ্যোতির্বিদ। মাত্র দশ বছরেই ইবনে সিনা পবিত্র কুরআন হিফয করেন। ধারণা করা হয় যে এই রাজ্যচিকিৎসক ৪৫০টি গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। তবে তাঁর লেখা ৫ খণ্ডের “আল কানুন ফিত তিবব” চিকিৎসাশাস্ত্রের একটি অমর গ্রন্থ। ড. ওসলার এ গ্রন্থটিকে চিকিৎসাশাস্ত্রের বাইবেল বলে উল্লেখ করেন। ইউরোপে আভিসেনা (Avicenna) নামে পরিচিত এই মনীষী অনেক দেশ ভ্রমণ করেছেন। ইবনে সিনার চিন্তা ও কর্মে চিকিৎসাবিজ্ঞান অনেকখানি সমৃদ্ধ হয়। তিনি দর্শন, ইতিহাস, অর্থনীতি, রাজনীতি, গণিত, ন্যায়শাস্ত্র, চিকিৎসাবিজ্ঞান ইত্যাদি বিষয়ে জ্ঞান লাভ করেন। ২১ বছর বয়সে তিনি “আল মুজমুয়া” নামে একটি বিশ্বকোষ রচনা করেছিলেন। কথিত আছে যে তিনি চিকিৎসাবিষয়ক গবেষণার পাশাপাশি অধিবিদ্যা, ধর্মতত্ত্ব এবং দর্শনের মৌলিক বিষয়ে ধ্যান ও গবেষণা করতেন। তাঁর বিখ্যাত দর্শন বিষয়ক গ্রন্থ হলো “আল শিফা”।
আল মাস’উদি
আবু আল-হাসান আলী ইবন আল হুসেন ইবনে আলী আল মাস’উদি ছিলেন একজন মুসলিম ইতিহাসবিদ এবং ভূগোলবিদ। তিনি সৃষ্টিতত্ত্ব, আবহাওয়াবিদ্যা, শরিয়াত, জ্যোতির্বিজ্ঞান, ভ্রমণ, আরব লোকসংস্কৃতি ইত্যাদি বিষয়ে বিপুল পরিমাণ জ্ঞানার্জন করেছিলেন। মাস’উদী “আরবের হেরাডোটাস” নামেও খ্যাত। তিনি তৎকালীন সময়ের প্রচলিত অনেক কুসংস্কার থেকে নিজেকে মুক্ত করতে পেরেছিলেন এবং মুক্তভাবে জ্ঞান চর্চায় নিজেকে নিয়োগ করেছিলেন। তিনি পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে পৃথিবী যে গোলাকার সে বিষয়ে পুরোপুরি নিশ্চিত হয়েছিলেন। এই জ্ঞান তাপসের মতে মানুষের জীবনধারাকে প্রাকৃতিক পরিবেশ তিনটি বিষয় দ্বারা প্রভাবিত করেঃ পানি, উদ্ভিদ এবং বাস্তুসংস্থান। তিনি মনে করতেন যে এই বিশ্বকে চতুর্দিক থেকে একটি মহাসমুদ্র ঘিরে আছে। তবে তিনি আরব ও চীনের মধ্যবর্তী পারস্য সাগরসহ মোট ৭টি সাগরের সীমানা ও দিক নির্ণয় সম্পর্কে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছিলেন। লেখক হিসেবেও তিনি ছিলেন অসাধারণ! তাঁর উল্লেখযোগ্য একটি বই হলো “কিতাব আল মুরাজ আল দাহাব”, যা পরবর্তীতে “গোল্ডেন মিডোজ” নামে ইংরেজীতে অনুবাদিত হয়েছিল।
ওমর খৈয়াম
গিয়াসউদিন আবুল ফাতেহ ওমর ইবনে ইব্রাহিম আল খৈয়াম একজন কবি, জ্যোতির্বিদ, গণিতবিদ ও দার্শনিক। তাঁর গুরুত্বপূর্ণ “Treatise on Demonstration of Problems of Algebra“ গ্রন্থে তিনি ত্রিঘাত সমীকরণের সমাধানের একটি বিশেষ পদ্ধতি বর্ণনা করেন। তাঁর আরেকটি চমৎকার বই হলো “কিতাবুল জিবার ওয়াল মুকাবালা”, যেটি গণিতশাস্ত্রের একখানি অমর গ্রন্থ। তিনি ঘন সমীকরণ এবং অন্যান্য উন্নত শ্রেণির সমীকরণের পদ্ধতির বিশ্লেষণ এবং সংজ্ঞানুসারে এগুলোকে শ্রেনিভুক্ত করেন। এ ব্যাপ্রে তিনি গ্রিকদের থেকেও বেশি পারদর্শিতা দেখিয়েছেন। বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী পারস্যের এ দার্শনিক বছরের দৈর্ঘ্য পরিমাপ করেছিলেন। ওমর খৈয়ামের কবিতাসমগ্রকে বলা হয় “রূবাইয়াৎ”। ইতিহাসবিদ নাফসির মতে, ‘রুবাইয়াত’ এ প্রায় ২,০০০ চতুষ্পদী কবিতা আছে। বাংলা সাহিত্যে ওমর খৈয়ামের রুবাইয়াৎ বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামসহ অনেকেই অনুবাদ করছেন। বিখ্যাত মুসলিম মনীষী জামাকসারি ওমর খৈয়ামকে “বিশ্ব দার্শনিক” হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলেন।
ইবনে খালদুন
আবু জায়েদ আবদুর রহমান বিন মুহাম্মদ বিন খালদুন আল হাদরামি ১৩২২ সালে জন্মগ্রহণ করেন। বাল্যকাল থেকেই ইবনে খালদুন জ্ঞান চর্চায় নিজেকে নিয়োজিত করেছিলেন। যে কয়জম মুসলিম মনীষীদের কারণে বিশ্বের জ্ঞানভাণ্ডার সমৃদ্ধ হয়েছিল, তাঁদের মধ্যে ইবনে খালদুন একজন শ্রেষ্ঠ ব্যাক্তি, যিনি অত্যাচারী শাসকদের স্বৈরাচারের বিরোধিতা করে বছরের পর বছর কারাগারে দিন কাটিয়েছেন। তিনি আমির মুহাম্মদ ইবনে আরিফের দেওয়া নিরাপত্তা ও সহযোগিতা পেয়ে বিশ্ববিখ্যাত গ্রন্থ “আল মোকাদ্দিমা” রচনা করেন। তিনি এই বইটিতে “আসাবিয়াহ” নামে নতুন একটি মতবাদ তুলে ধরেন। এই বইটি তাঁকে একজন শ্রেষ্ঠ সমাজবিজ্ঞানী ও দার্শনিক হিসেবে সুখ্যাতি দান করে। লুববু-ল-মুহাসাল ফি উসওলু-দি-দ্বীন এবং সিফাউস-সায়েলতাঁর অন্যতম দু’টি গ্রন্থ। তিনি সমাজবিজ্ঞান সম্পর্কে অনেক নতুন নতুন তথ্য তুলে ধরেছিলেন। ইবনে খালদুন তার জ্ঞান ও প্রতিভা দিয়ে একটি অনিবার্য সংঘাত থেকে দেশ ও জাতিকে রক্ষা করেছিলেন। ইবনে খালদুন আইনে, কুরআন ও হাদিসের ভিত্তিতে সামাজিক নৈতিকতা এবং আরবি ভাষা সম্পর্কে প্রচুর অধ্যয়ন করেছেন। এ মুসলিম মনীষী যে জ্ঞান রেখে গেছেন, তা ইতিহাসের পাতায় বিরল।
আল বিরুনি
আবু রায়হান মোহাম্মদ ইবনে আহমদ আল বিরুনি একজন আরবীয় গবেষক এবং শিক্ষাবিদ ছিলেন। প্রফেসর মাপা বলেন, “আল-বেরুনি শুধু মুসলিম বিশ্বেরই নন, বরং তিনি ছিলেন সমগ্র বিশ্বের শ্রেষ্ঠ জ্ঞানীদের একজন।” তাঁকে “প্রথম নৃ্তত্ত্ববিদ” হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। জ্যোতির্বিজ্ঞান, গণিত, দর্শন, পদার্থবিজ্ঞান, চিকিৎসাশাস্ত্র, রসায়ন, ন্যায়শাস্ত্র, ইতিহাস, জীববিজ্ঞান, ভূতত্ত্ব কিংবা ধর্মতত্ত্ব প্রভৃতি বিষয়ে অসাধারণ পাণ্ডিত্য ছিলো তাঁর। আল বিরুনি “আল উসতাদ” নামে খ্যাতি অর্জন করেন। তিনি অতীতের মনীষীদের কাজগুলোর চমৎকার ব্যাখ্যা দিয়েছেন। ইসলামেও যে মুক্ত চিন্তা সম্ভব, তিনি তার প্রমাণ দিয়েছিলেন। আল বিরুনির অন্যতম দু’টি বই হলো ‘আল আশার আল বাকিয়াহ’ ও ‘আন আল কুরুন আল খালিয়াহ’। এছাড়াও তিনি আরও প্রায় শতাধিক বই লিখেছেন, যেগুলোতে জ্ঞানের বিশাল ভান্ডার খুঁজে পাওয়া যায়। তাঁর লেখা বই ‘ইন্ডিয়া’ বইটির কারণে তিনি ভারতীয় উপমহাদেশের মানুষদের কাছে একজন বিখ্যাত ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত।
মুসা আল খাওয়ারেযমি
আবু আব্দুল্লাহ্ মুহাম্মাদ ইবনে মুসা আল খাওয়ারেযমি একজন গণিতজ্ঞ, ভূগোলবিদ এবং জ্যোতির্বিদ। তিনি গণিতশাস্ত্রের সর্বাধিক প্রসিদ্ধ ব্যক্তি। তাঁকে কখনো কখনো “গণিতশাস্ত্রের জনক” বলে আখ্যা দেওয়া হয়। বীজগণিতের আবিষ্কারক হলেন তিনি। এ বিষয়ে তাঁর রচিত “হিসাব আল জাবর ওয়া আল মুকাবালাহ” গ্রন্থের নামানুসারে এ শাস্ত্রকে পরবর্তীকালে ইউরোপীয়রা অ্যালজেবরা নামকরণ করে। তিনি এ গ্রন্থে আট শতাধিক উদাহরণ সন্নিবেশিত করেন। সমীকরণ সমাধান করার ৬ টি নিয়ম আবিষ্কার করেন। এটি দ্বাদশ শতাব্দীতে ল্যাটিন ভাষায় অনূদিত হয়ে ইউরোপের বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে পঠিত হতো। “কিতাবুল হিসাব আল আদাদ আল হিন্দী” তাঁর পাটিগণিত বিষয়ক গ্রন্থ। তাঁর গণিতশাস্ত্র দ্বারা ওমর খৈয়াম, লিওনার্ডো, ফিরোনানসি, মাস্টার জ্যাকবসহ আরও অনেকেই প্রভাবিত হয়েছেন। তিনি ত্রিকোণমিতিতেও বিশাল ভূমিকা রেখেছিলেন। মুসা আল খাওয়ারেযমি ত্রিকোণমিতিক ফাংশন সাইন এবং কোসাইন এর অনুপাত নিয়ে কাজ করেছিলেন। তাঁর অন্যতম একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো টলেমির Geography বইটি সংশোধন করা। তাঁর রচিত “সুরত আল আরদ” গ্রন্থটি বিশ্বের প্রথম মানচিত্র হিসেবে বিবেচিত। মুসা আল খাওয়ারেযমি ইসলামের স্বর্ণযুগের একজন শ্রেষ্ঠ জ্ঞান তাপস।
ইবনে আল হায়সাম
হাসান ইবনুল হায়সাম দর্শন,ধর্মতত্ত্ব, চিকিৎসাবিজ্ঞান, আলোকবিজ্ঞান, জ্যোতির্বিজ্ঞান এবং গণিতের উপর বেশ কিছু কাজ করেছিলেন। তিনি আলোর প্রতিসরণ এবং প্রতিফলন নিয়ে গ্রিকদের ভুল ধারণা খণ্ডন করেন। হাসান ইবনুল হায়সামই সর্বপ্রথম প্রমাণ দিতে সক্ষম হয়েছিলেন যে আলো কোনো একটি বস্তু হতে প্রতিফলিত হয়ে চোখে আসে বলেই তা আমাদের কাছে দৃশ্যমান হয়। বহুবিদ্যাবিশারদ হায়সাম আধুনিক আলোকবিজ্ঞানের চর্চার পথে পথিকৃত। তাঁকে আলোকবিজ্ঞান(Optics) এর স্থপতি বলা হয়। ইতিহাসবিদ আবুল হাসান বায়হাকি তাকে “দ্বিতীয় টলেমি” বলে আখ্যা দিয়েছিলেন। ইবনে আল হায়সামের সবচেয়ে বিখ্যাত কাজ হচ্ছে তাঁর ৭ খন্ডে রচিত আলোকবিজ্ঞানের উপর গবেষণা গ্রন্থ “কিতাবুল মানাযির”। মধ্যযুগে আলোকবিজ্ঞানের এটিই একমাত্র গ্রন্থ। বেকন, কেপলার, নিউলার্ডো প্রমুখ এ গ্রন্থের উপর নির্ভর করেই তাঁদের গবেষণা করেছিলেন। তিনি আলো সম্পর্কে আরো কিছু গবেষণাপত্র লিখেছেন, তার মধ্যে অন্যতম হলো রিসালা ফি’ল দাও । যাতে তিনি ঔজ্জ্বল্য, রংধনু, গোধুলি ইত্যাদি বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছেন। তিনিই ম্যাগনিফাইং গ্লাস আবিষ্কার করেন। আধুনিক কালের বিজ্ঞানীরা গতিবিজ্ঞানকে তাদের আবিষ্কার বলে দাবি করলেও ইবনে হায়সাম এ বিষয়ে পূর্বেই বিস্তারিত বর্ণনা করেছিলেন। তিনি তাঁর গ্রন্থসমূহে মাধ্যাকর্ষণ সম্পর্কে কিছু বিষয় তুলে ধরেছিলেন। স্যার আইজ্যাক নিউটনকে মাধ্যাকর্ষণ শক্তির আবিষ্কারক মনে করা হলেও হায়সাম এ বিষয়ে প্রথম ধারণা দিয়েছিলেন বলে মনে করা হয়। মনোবিজ্ঞানী ওমর খালিফা হায়সামকে পরীক্ষামূলক মনোবিজ্ঞানের জনক হিসেবে অভিহিত করেছিলেন।
আল-কিন্দি
আবু ইউসুফ ইয়াকুব ইবনে ইসহাক আল-কিন্দি একজন প্রখ্যাত দার্শনিক, জ্যোতির্বিদ, বিশ্বতত্ত্ববিদ, , সঙ্গীতজ্ঞ, রসায়নবিদ, যুক্তিবিদ, গণিতজ্ঞ, পদার্থবিদ এবং মনোবিজ্ঞানী। তাঁর মতে পৃথিবীতে যা কিছুর অস্তিত্ব রয়েছে, তাদের প্রত্যেকের মাঝে সত্য অন্তর্নিহিত রয়েছে। পাশ্চাত্যে “আলকিন্ডাস” নামে খ্যাত এই অসাধারণ জ্ঞানী চিন্তাবিদ ক্রিপ্টোগ্রাফির জনক হিসেবে স্বীকৃ্ত। তাঁকে পেরিপ্যাটেটিক দর্শনের জনক বলা হয়। তাঁর সবচেয়ে বড় সাফল্য হলো তিনি স্থানীয় মুসলিম দর্শনের সাথে পাশ্চাত্য এবং প্রচলিত গ্রীক দর্শনের সমন্বয় ঘটিয়েছিলেন। তিনি অ্যারিস্টটলের ধর্মতত্ত্ব আরবিতে অনুবাদ করেছিলেন। আল কিন্দি নিউপ্লেটোনিজমের উদ্ভাবক ছিলেন। তিনিই সর্বপ্রথম অ্যারিস্টটল ও প্লেটোর মতবাদ সমন্বয় করার চেষ্টা করেন। তিনি অনধিক ৩৬৫টি গ্রন্থ রচনা করে জ্ঞান-বিজ্ঞানের ভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করেন। তাঁর মতে গণিত ছাড়া দর্শনশাস্ত্র অসম্ভব। তিনি মাতৃভাষা আরবি ছাড়াও পাহলবি, গ্রিক, সংস্কৃত ও সিরীয় ভাষায় সুপণ্ডিত ছিলেন। জ্ঞানের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে তিনি ৩টি পৃথক বিষয় প্রবর্তন করেন: ইন্দ্রিয়, বুদ্ধি এবং কল্পনা। তাঁর মতে ইন্দ্রিয় এবং বুদ্ধির মাঝে সমন্বয় সাধন করে কল্পনা। বহুভাষী এই বহুবিদ্যাবিশারদ এখনো বরণীয় ও স্মরণীয় হয়ে আছেন।
শেষ কথা
ইতিহাসের এই ১১জনের মুসলিম মনীষীর অবদান যে কতটা ব্যাপক, তা এতক্ষণে আপনি বুঝতে পেরেছেন। এছাড়াও আরও বেশ কয়েকজন দার্শনিকের কথা না বললেই নয়। তাঁদের মধ্যে মুহাম্মাদ আল মোকাদ্দাসি, সুফি জুননুন মিসরি, আবুল হাকিম মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল মালিক আল খাওয়ারেযমি আল কাসি, ইয়াকুত ইবনে আব্দুল্লাহ আল হামাবি, মুহাম্মাদ নাসির উদ্দিন তুসি প্রমুখ অন্যতম। গ্রিকদের বিজ্ঞানের উত্থান পর্বের পর প্রায় দেড় হাজার বছর জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। তখন ভারতীয় এবং চীনা ধারার সভ্যতার পাশাপাশি মুসলিম সভ্যতা জ্ঞানচর্চাকে বাঁচিয়ে রেখেছিল। যদি ঐ সময়ে মুসলমানেরা এই মহৎ কর্মে আত্ননিয়োগ না করতো, তবে আধুনিক সভ্যতা কখনোই এত দ্রুত এ পর্যন্ত আসতে পারতো না। আমরা এমনি কয়েকজন মুসলিম মনীষী সম্পর্কে জানলাম, যাঁদের দ্বারা ইউরোপ-আমেরিকা প্রভাবিত হয়েছিল। সবশেষে একটি কথা সবাইকে স্বীকার করতে হবেই যে মধ্যযুগের মুসলিম মনীষীরাই আধুনিক বিজ্ঞানের স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন, যা রেঁনেসার যুগের বিজ্ঞানীগণ বাস্তবায়ন করেছেন। জ্ঞান-বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে তাদের অক্লান্ত পরিশ্রম ও বহুমুখী অবদান বর্তমান মুসলিম জগৎকে নতুন করে জ্ঞান চর্চায় অনুপ্রাণিত করে। তো, এই আর্টিকেলটি পড়ে আপনি যদি নতুন কোনো বিষয় জেনে থাকেন তবে অবশ্যই পরিচিতদের সাথে শেয়ার করবেন এবং আপনারও যদি এমন কোনো বিষয় জানা থাকে, তবে কমেন্ট করে জানাতে ভুলবেন না।